• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

বঙ্গবন্ধুকে  যেমন দেখেছি 

প্রকাশ:  ১৭ মার্চ ২০২২, ০৩:৫৫
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

বাঙালির নয়নের মণি, শ্বাস প্রশ্বাস, হৃদয়ের ধন শেখ মুজিব। খুলনা ও বর্তমান বৃহত্তর ফরিদপুর জেলাকে ভাগ করা মধুমতি নদীর তীরে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন শেখ পরিবারের বড় ছেলে মুজিবুর রহমান। নিষ্ঠাবান, সৎ ও কর্তব্যপরায়ণ পিতা শেখ লুৎফর রহমান নিজ জীবনের আদর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়েই শিশু-কিশোর মুজিবকে জীবন ও কর্মের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করেন। স্নেহময়ী মাতা সায়েরা খাতুনের মায়া মমতা ছাড়াও হয়ত বা নিজের অজান্তেই ব্যবস্থাপনার দীক্ষা দেন বড় ছেলেকে। রত্নগর্ভা সায়েরা খাতুনের কথা, ‘আমার আব্বা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন যাতে তার বাড়ীতে আমি থাকি। শহরে চলে গেলে ঘরে আলো জ্বলবে না, বাবা অভিশাপ দেবে।’ পিতা মাতা ছাড়াও বিদ্যালয়ের বিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী এবং গৃহশিক্ষকের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয় বরং জীবন চলার পথে অমূল্য সাংগঠনিক ক্ষমতা ও নেতৃত্বের শিক্ষা গ্রহণ করেন। রাজনীতির দীক্ষা তিনি গ্রহণ করেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে। প্রথম দিকে কোন কারণে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে তেমন পছন্দ না করলেও মা, বাবা, গুরুজন ও পাড়ার মুরুব্বীগণের পরামর্শে হক সাহেব সম্পর্কে কোন কটু কথা বলা থেকে বিরত থাকেন তিনি।

মহকুমার সেরেস্তাদার শেখ লুৎফর রহমানের কর্মস্থল গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পিতার গলা ধরে না ঘুমালে রাতে তার ঘুম আসতো না।

প্রথমে বেরি বেরি ও পরে চক্ষু রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৪ সন থেকে প্রায় তিন বছর তার লেখাপড়া ব্যাহত হয়। তবে খেলাধুলা, ছুটাছুটি ও দুরন্তপনায় বেড়ে উঠা শেখ মুজিব শারীরিকভাবে শক্তিমান ছিলেন। ইস্পাত কঠিন মন মানসিকতা গঠনেও এটি সহায়ক ছিল। ছেলেবেলায় বাড়ির ক্ষীয়মান সুপ্রাচীন অট্টালিকা প্রত্যক্ষভাবে দেখে আর জনশ্রুতিতে বিত্তবান শেখ পরিবারের কালক্রমে মধ্যবিত্তে অবদমনের পরোক্ষ কানাঘুষায় বেদনাভারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জুলুম ও অন্যায় অত্যাচারে ক্ষতিগ্রস্ত শেখ পরিবারের ব্যবসা বাণিজ্য আর সামান্য ভুল বোঝাবুঝির ফলে এলাকায় অন্য সভ্রান্ত উচ্চবিত্ত কাজী বংশের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী মামলা মোকদ্দমাই যে বস্তুগত এই অবনতির মূল কারণ তা তিনি সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। রাজনীতিতে শেখ মুজিবের হাতেখড়ি সেই অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকাল থেকে। গ্রামের দরিদ্র আত্মীয় ও অন্যান্য দারিদ্র জর্জরিত মানুষের বেদনায় তার মন ভারাক্রান্ত হতো এবং নিজের যথা সর্বস্ব দান করে তাদের দুঃখ দূর করতেন।

ছাত্র সংগঠন, মুসলিম লীগের সংস্পর্শ, স্বদেশী আন্দোলন, ইসলামীয়া কলেজ, বেকার হোস্টেল এবং ১৯৪৩ সনের দুর্ভিক্ষ আর ১৯৪৬ সনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতার মধ্য দিয়েই যুবক শেখ মুজিব একজন খাঁটি প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও জনদরদী দরিদ্র অন্তপ্রাণে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে তৈরি করেন। সে সময় ও পরবর্তীতে আবারও ব্রিটিশ শাসন শোষণ তিনি দেখেছেন। প্রকৃতপক্ষে ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে শতকরা ৫৬ ভাগ অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার বরাদ্দে মাত্র ১৫ শতাংশ সম্পদ, চাকুরি, সুযোগ ও ক্ষমতার ভাগ দিয়ে বাংলাকে শোষণ, জুলুম ও নির্যাতনে কীভাবে সর্বনাশের শেষ প্রান্তে নিয়ে যায় তা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, উপলব্ধির যাতনায় ভুগেছেন আর চূড়ান্ত পরীক্ষায় শান্তিপূর্ণ হলেও জোরদার স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

দ্বিজাতিতত্ত্ব তথা ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে শুরু থেকেই বাঙালীরা অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাই রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন, সাংবিধানিক কাঠামোতো বাঙালীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং রাজনীতি ও অর্থনীতির স্বার্থরক্ষার আন্দোলন দিনে দিনে তীব্র হয়। পূর্ব বাংলা প্যারিটি ফর্মূলা প্রত্যাখ্যান করে। জনমিতির সংখ্যার অনুপাতেই সকল বিষয়ে শতকরা ৫৬ ভাগ অধিকারের আন্দোলন সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সনে শেখ মুজিব ছ’দফা দাবি তথা বাঙালীর মুক্তি সনদ ঘোষণা করেন। বিশ্ববাসীকে জানান দেয়া হলো যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র টিকে থাকলেও তার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বাসস্থান পূর্ববাংলা প্রায় ষোলো আনা স্বায়ত্বশাসন নিয়েই বিরাজ করবে।

উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানে বাংলার দামাল ছেলে-মেয়েরা জেলের তালা ভেঙে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশের অনিবার্যতা নিশ্চিত করে দেয়। আর বাংলার শার্দুল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই যে এতে অপরিহার্য নেতৃত্ব দেবেন তাতেও কোন সন্দেহের অবকাশ থাকেনি। তারই প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বর ১৯৭০ সনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে। সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক তথা সদরে মামলুকাত জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হবার ইচ্ছা অত্যন্ত প্রবল ছিল।

আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল- পূর্ব বাংলার জনগণ তথা পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণেই ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত হতে পারবেন বলে গোয়েন্দারা তাদের সচরাচরিত ‘প্রভু কি শুনতে চান’ সে ধরনের প্রতিবেদন দিলো। তাকে জানানো হলো যে পূর্ব বাংলার (পাকিস্তানে) শেখ মুজিবুরের আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনের অধিকাংশতে জয়লাভ করবে বটে- তবে অন্যান্য দলের বড় বড় নেতারা যথেষ্ট পরিমাণ আসনে জয়ী হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩১ আসনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যগণ সংযুক্তিতে অন্ততঃ ১৫১টি আসন পাবে। ফলে যে কোয়ালিশন হবে তাতেই শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখা যাবে। সে বিশ্বাসে বিভোর হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মহা আনন্দে নির্বাচনে গেলেন কারণ, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের (এলএফও) অধীনে ভোটে যেতে রাজি হয়। অবশ্য যেটা তিনি বিশ্লেষণে আনেননি সেটা হলো, ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ এর যে ফর্মূলায় তিনি পাকিস্তানে নির্বাচন করতে প্রথম বারের মতো রাজি হন তার ফলশ্রুতিতে রাজপথে অপ্রতিরোধ্য শেখ মুজিব যে অপরিহার্যভাবেই সারা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যেতে পারেন তা তিনি হিসাবে নেননি। ইয়াহিয়া খানের কাছে গোয়েন্দারা এ তথ্য দেয় নাই যে খোদ পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশেই শেখ মুজিবের ন্যায়সংগত ছয় দফার সমর্থক ছিলেন, প্রকৃতপক্ষে অন্ততঃ ৮ জন এমএনএ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় চলে এসেছিলেন এবং শেখ মুজিবকে সমর্থন দিয়ে ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদে যোগদান করতে প্রস্তুত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ১৬৭+ পশ্চিম পাকিস্তানের ৮ জন (মিয়া মমতাজ দওলতানা, মালিক গোলাম জিলানী, আইয়ুব খুরো, আহমদ আলী তালপুর, আব্দুল ওয়ালি খান, গউস বকশ বেজেঞ্জা, খায়ের বক্‌শ মারী ও আতাউল্লা খান মঙ্গল+ ২ (নূরুল আমিন ও রাজা ত্রিদিব রায়)।

ইতিমধ্যে নির্বাচনে পূর্ব বাংলার ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছ’দফার মূলমন্ত্রের ম্যান্ডেট সহকারে ঢাকায় ৩রা মার্চের অধিবেশনে যোগ দিতে প্রস্তুত থাকলেন। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা এবং প্রধান মন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করবেন সেটাই সংবিধান অনুসারে নিশ্চিত ছিল। অবশ্য বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ছ’দফা তখন বাংলার গণমানুষের দাবি হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের কোন সদস্য যদি যুক্তিসংগত কোন সংশোধনী দেন তাহলে সংবিধান প্রণয়নে তা বিবেচনায় আনা হবে।

আচমকা ১ মার্চ দুপুরে বেতার ভাষণে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন বাতিল করে দিলেন। পূর্ব বাংলায় আগুন জ্বলে উঠে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। উঠানো হয় স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের মাঝখানে হলুদ সূর্যের দেদীপ্যমান পতাকা। অনুমোদন করা হয় জাতীয় সংগীত। সারা বাংলাদেশে এক অভুতপূর্ব জাগরণের সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকিং, রাজস্ব, বাণিজ্য, যোগাযোগ ও শিক্ষাসহ প্রশাসনিক ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চলতে থাকে। আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রচন্ড চাপে পড়ে ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন পুনরায় শুরু করার জন্য ২৫শে মার্চ ধার্য করেন এবং আলোচনার প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩-৬ মার্চ শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন পালন করে ৭ই মার্চ তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে সমাবেশ ডাকেন। গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দানের ঘোষণা দেন। ভয়ে ভীত পাকিস্তানি প্রশাসন নানা দুরভিসন্ধি গ্রহণ করে এবং রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারে বিধি নিষেধ আরোপ করে। পাকিস্তানী সেনা অফিসার সিদ্দিক সালিক তার উইটনেস টু সারেন্ডার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রেডিওর ঘোষকরা আগে থেকেই রেসকোর্স থেকে ইস্পাত দৃঢ় লক্ষ দর্শকের নজিরবিহীন উদ্দীপনার কথা প্রচার করতে শুরু করলো। সামরিক আইন প্রশাসকের দফতর হস্তক্ষেপ করে এই বাজে ব্যাপরটি বন্ধের নির্দেশ দিলো।’ বেতারের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ রাখার হুমকি দিয়ে প্রতিবাদ জানান। আওয়ামী লীগের কট্টরপন্থীগণ এবং ছাত্রলীগের যুবা নেতারা এই ৭ই মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর উপর চাপ দিতে থাকেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে গভর্ণর এম আহসান ও প্রাদেশিক সামরিক প্রশাসক সাহিবজাদা ইয়াকুব খান বঙ্গবন্ধুকে সাফ জানিয়ে দেন যে, স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বোমা মেরে লক্ষ জনের মৃত্যু ঘটাতে হলেও রেসকোর্স ময়দানকে খালি করে দেয়া হবে। এ সকল চাপের মুখে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরামর্শ দিলেন, ‘তোমার মনে যা আসে তাকেই সঠিক সিদ্ধান্ত মনে করে ভাষণ দেবা’।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ১৯৭১ এ ১৮ মিনিটের ভাষণটি তার স্বভাবসুলভ তাৎক্ষণিক বক্তব্য ছিল, কোন পূর্বে তৈরি করা বক্তৃতা নয়। এটিকে অনেকেই রাজনীতির কবিতা বলে থাকেন। তুলনা করা হয় আব্রাহাম লিংকন, উইনস্টন চার্চিল, মার্টিন লুথার কিং ও পেরিক্লিসের মহতী যুগান্তকারী ভাষণগুলোর সঙ্গে। এর মহত্ব ও বিরাটত্বের কারণে ২০১৮ সনে জাতিসংঘের এডুকেশন, কালচার ও সাইন্টিফিক অর্গানাইজেশন, ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের অসাধারণ ভাষণটিকে পৃথিবীর অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালী জাতিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ভাষণটির অসাধারণত্ব, এর স্বতঃস্ফুর্ততা, নির্ভীকতা, সম্যক উপলব্ধি ও তেজস্বী উচ্চারণ প্রকৃতপক্ষে বাঙালী জনগণের প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার চরম ও পরম আকাঙ্খাকে বাঙময় করে তোলে। সামগ্রিক বিচারে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি স্বাধীনতাকে সংজ্ঞায়িত করেছে, চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা অর্জনের দিক নির্দেশনা দিয়েছে, প্রকাশ করেছে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের রূপরেখা- রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা এবং কল্যাণ রাষ্ট্রে বিশেষ করে কম ভাগ্যবানদের অর্থনৈতিক মুক্তিসহ সোনার বাংলা গড়ে তোলা। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর বলিষ্ঠ প্রত্যয় আছে এ ভাষণের বাক্যগুলির অন্তরে অন্তরে। স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত লক্ষ কোটি বাঙালীকে বাঁশের লাঠি আর দা কুড়াল নিয়ে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে সুসজ্জিত পাকিস্তানী দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী প্রত্যয় নিয়ে রাস্তায় নেমে আসার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নাই।

শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আশা করেছিলেন যে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় দেশের দ্বিতীয় রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ শুরু তার পরামর্শক্রমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সন তারিখে নির্ধারণ করাই হবে গণতন্ত্রের সর্বজনীন রীতি। ভাষণে তিনি আক্ষেপ করে বললেন, ‘তিনি আমার কথা রাখলেন না- রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা’। অর্থাৎ সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের নেতার পরামর্শক্রমে জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকা একেবারেই গণতন্ত্রের পরিপন্থী বলে তিনি জানালেন।

একজন ঝানু সমরবিদের মতই বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে নিরাপদ রুটে পিছু হটার সুযোগ করে দেন। ২৫ মার্চের পুনরায় ডাকা সংসদে বসা কেন অসম্ভব তা তিনি ভাষণে যথার্থভাবেই ব্যাখ্যা করে বললেন, যে শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাস্তার দাগ তখনো শুকোয়নি। শহীদদের পবিত্র রক্ত পদদলিত করে ২৫ মার্চ তারিখে সংশোধিত সংসদ অধিবেশনে আওয়ামী লীগ যোগদান করতে পারে না। তিনি সংসদে ফিরে যেতে চারটি শর্ত দিলেন:- ১) সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, ২) যারা ১লা মার্চ থেকে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত তাদের শাস্তি দিতে হবে, ৩) সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, ৪) সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

সেই বাঙালির রক্ত ঝরানো পথে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সংসদে যাবার জন্য যে কয়েকটি শর্ত আরোপ করলেন সেগুলোকে নমনীয় বলা যেতেই পারে। তবে এ সকল শর্ত মানা হলে বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদের অধিবেশনে গেলে ৩০০ সদস্যের মধ্যে মোট ১৭৭ জন সদস্যের সমর্থন নিয়ে ছ’দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান রচিত হলে এটি যে প্রকৃতপক্ষে পূর্ববাংলার স্বাধীনতারই রূপায়ণ হতো সে বিষয়ে কারও কোন সন্দেহ ছিলো না। তাই ইয়াহিয়া-ভুট্টো আঁতাত আলোচনার নামে কালক্ষেপণ ও সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্র বৃদ্ধির আয়োজন করেন। কিছু ভাষ্যকারও সব বিষয়ে মুজিব বিরোধী দোষারুপ করেন যে, ৭ই মার্চের ভাষণে প্রকান্তর না করে প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া উচিত ছিল। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় হিসাব নিকাশ করেই প্রত্যক্ষ ঘোষণাটি দেন নাই। কারণ শতকরা ৫৬ ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। সর্বোপরি সারা পৃথিবীতে বিচ্ছিন্নতাবাদীকে কেউ আমল দেয় না। সে অপবাদ বঙ্গবন্ধু নিতে চান নাই। নিতে হয়ও নাই। পাকিস্তান ভাঙার দায় পশ্চিম পাকিস্তান তথা সেনা শাসককূলের উপরই পড়েছিল। সারা দুনিয়াতে বাঙালীর ন্যায়ানুগ দাবির প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি জেগে উঠে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা এবং শান্তিপূর্ণভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মত অনুসারে পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশলের প্রতি বিশ্বব্যাপী শুভ কামনার জোয়ার সৃষ্টি হয়। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে পাকিস্তানি শাসককূলের গণতন্ত্র পরিপন্থী জবরদস্তিমূলক শাসন চাপিয়ে দেয়ার প্রতি ঘৃণা। জোর সমর্থন ও শুভ কামনায় সিক্ত ও সমৃদ্ধ হয় বাঙালীর গৌরবে উজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি।

বঙ্গবন্ধুকে মন্তব্য ও ভাষ্য: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের মহানায়ক বলা হয়। ফিডেল ক্যাস্ট্রো জাতির পিতাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু তোমাকে দেখেছি’। রবার্ট ফ্রস্ট অত্যন্ত আবেগঘনভাবে বঙ্গবন্ধুর ইন্টারভিউ প্রচার করেছেন। আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি কী প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বললেন, ‘আই লাভ মাই পিপল’। আর আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী? সে প্রশ্নের জবাবে হৃদয়বান বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আই লাভ দেম টু মাচ’। সেই হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, আমি অনেক রাজা, বাদশা, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সাক্ষাৎকার পেয়েছি। কিন্তু এমন একজন জাতির পিতার দেখা পেয়েছি যার নাম শেখ মুজিব।

প্রফেসর অনুপম সেন বলেছেন, ‘১৯৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অসাধারণ ভাষণে বাঙালী জনগণের স্বাধীনতার এই পরম ও চরম আকাঙ্খাকে মূর্ত করেছিলেন। বাঙালীর উপর অত্যাচারের, নির্যাতনের ও শোষণের চিত্র তুলে ধরেছিলেন অনন্য আবেগে ও তীব্র জ্বালাময়ী ভাষায়।’

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান লিখেছিলেন, ‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক ‘গ্রিন সিগন্যাল’ বলে মনে হলো।’

পরিশেষে: বঙ্গবন্ধু (পরবর্তীতে জাতির পিতা) তার ৭ই মার্চের অনুপম ভাষণ শেষ করলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই স্বপ্ন সাধনার বাংলাদেশ আজ জাতির পিতার সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনার পিতার নির্দেশিত পথে উদ্ভাবনী, প্রত্যয়ী, প্রযুক্তি নির্ভর, সামনে থেকে সাহসী ও অসাধারণ নেতৃত্ব দিতে পারার কল্যাণে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মহাসড়কে বিপুল বেগে অগ্রসরমান।

লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক/ বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব

পূর্বপশ্চিম- এনই

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন,বঙ্গবন্ধু
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close